বন্যা দুর্গত এলাকার বিপর্যস্ত জনজীবনের বিবরণ দিয়ে একটি প্রতিবেদন রচনা কর।
অথবা, সম্প্রতি বন্যায় তোমার এলাকায় ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ দিয়ে একটি প্রতিবেদন রচনা কর।
অথবা, সম্প্রতি বন্যায় তোমার এলাকায় ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা দিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে একটি প্রতিবেদন রচনা কর।
অথবা, কোনো বন্যা-উপদ্রুত এলাকা পরিদর্শনের ওপর ভিত্তি করে একটি প্রতিবেদন রচনা কর।
প্রতিবেদনের প্রকৃতি : সংবাদ প্রতিবেদন
প্রতিবেদনের শিরােনাম : বন্যা দুর্গত কুড়িগ্রাম এলাকা : অসংখ্য মানুষ পানিবন্দি
সরেজমিনে পরিদর্শন : বন্যা কবলিত এলাকা, কুড়িগ্রাম
প্রতিবেদন তৈরির সময় : সকাল ১১:০০টা
তারিখ : ২৮/০১/২০২৩
সংযুক্তি : বন্যা কবলিত এলাকার মানুষের দুর্দশার ছবি (৫টি)
বন্যা দুর্গত কুড়িগ্রাম এলাকা : অসংখ্য মানুষ পানিবন্দি
বন্যা
একটি মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ । প্রায় প্রতি বছরই আমাদের দেশে বন্যার
প্রকোপ দেখা দেয় । আমাদের অতি পরিচিত এ প্রলয়ংকরী দুর্যোগের ফলে জীবন,
সম্পদ ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয় । অতীতের মতো এবারও আমাদের
এলাকা বন্যার প্রকোপ থেকে রক্ষা পায়নি । অসংখ্য পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে
বন্যার কারণে । বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ, যেমন— ডায়রিয়া, আমাশয়, জন্ডিস
ইত্যাদির প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে । নদীর পানি এখনও বিপদসীমার ওপর দিয়ে
প্রবাহিত হওয়ায় এলাকায় বেশ ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে ।
বন্যা কবলিত কুড়িগ্রাম এলাকার অবস্থা
কুড়িগ্রাম
এলাকায় বন্যা যেন অভিশাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে । এ এলাকার প্রায় পাঁচ লাখ
মানুষ বন্যা কবলিত হয়েছে । ঘরে ঘরে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট মারাত্মক
আকার ধারণ করেছে। ২০০ একর রোপা আমন ক্ষেত ডুবে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন
দরিদ্র কৃষকরা । ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে
প্রবাহিত হয়েছে। রৌমারীর শিবেরডাঙ্গি এলাকায় ডিসি রাস্তার ৮০ ফুট পানির
স্রোতে ভেঙে যাওয়ায় নতুন করে প্লাবিত হয়েছে ৭টি গ্রাম । রৌমারীর সঙ্গে
ঢাকার যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে । প্লাবিত গ্রামগুলো হলো-
শিবেরডাঙ্গি দক্ষিণ পাড়া, শিবেরডাঙ্গি উত্তর পাড়া, শিবেরডাঙ্গি পূর্ব
পাড়া, পূর্ব মরিচাকান্দি, উত্তর মরিচাকান্দি, দক্ষিণ মরিচাকান্দি ও
বালিয়ামারী । এতে করে ১২শত পরিবার পানিবন্দি হয়ে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের
শিকার হয়েছে । এছাড়া শিবেরডাঙ্গি ব্রিজের দুপাশের রাস্তাও ধসে পড়েছে।
এলাকাবাসীর এ ক্ষয়ক্ষতি অপূরণীয় । তাদের দুর্দশা লাঘবের উদ্দেশ্যে রৌমারী
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দুর্গত এলাকা
পরিদর্শন করেছেন । তবুও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি
হয়নি ।
অসহায় মানুষদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ
বন্যা
কবলিত এলাকার অসহায় মানুষদের জন্য ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়েছিল ।
ত্রাণসামগ্রীর প্রতি প্যাকেজের মধ্যে ছিল ১৫ কেজি চাউল, ২ কেজি চিড়া, আধা
কেজি গুড়, আধা কেজি লবণ, ১টি গ্যাস লাইট, ১ বাক্স ওরাল স্যালাইন ও ১ পাতা
পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট । কিছু কিছু এলাকার লোকজন ত্রাণ সহায়তা পেলেও
অনেক এলাকাতেই ত্রাণসামগ্রী পৌঁছায়নি । কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার
হাতিয়া ইউনিয়নের বাগুয়া অনন্তপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ত্রাণ বিতরণ করেন
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া
(বীরবিক্রম) । মন্ত্রী মহোদয়ের আগমনের খবর পেয়ে অসংখ্য নারী-পুরুষ ত্রাণ
লাভের আশায় সমবেত হয়। মন্ত্রী বেশ কয়েকজনের হাতে ত্রাণসামগ্রী তুলে
দেওয়ার পর চলে যান । এরপরই শুরু হয় ত্রাণসামগ্রী না পাওয়া মানুষের হৈচৈ ।
উপজেলা প্রশাসনের নির্দেশে মাত্র ৪০০ মানুষের নামের তালিকা তৈরি করে
ইউনিয়ন পরিষদ । কিন্তু এ তালিকার বাইরে রয়েছে আরও হাজারো ত্রাণ-না পাওয়া
মানুষ । এসব অসহায় মানুষ সাংবাদিকদের গাড়ি ঘিরে ধরে তাদের অভিযোগ জানায়
। এদের মধ্যে অনেকেই গৃহপালিত প্রাণীকে সাথে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে
মানবেতর জীবনযাপন করছে । অনেকে হাঁস-মুরগি বিক্রি করে দিয়েছে। কারও
বাড়িতে খাবার নেই, হাতে টাকা নেই, কেউ বা শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে ।
এ ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জানান, এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৪০০
পরিবারকে ১৬ মেট্রিক টন চাল দেওয়া সম্ভব হয়েছে । আরও ৬ টন চাল ২/১ দিনের
মধ্যে পাওয়া যাবে । ত্রাণ স্বল্পতার কারণে সবাইকে ত্রাণ দেওয়া যায়নি ।
বরাদ্দ পাওয়া সাপেক্ষে পর্যায়ক্রমে সবাইকে ত্রাণের আওতায় আনা হবে বলে
তিনি আশ্বাস দেন।
পুনর্বাসন ব্যবস্থার অভাবে অসহায় মানুষের দুর্ভোগ
কুড়িগ্রাম
এলাকার পানিবন্দি মানুষের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না হওয়ায়
তাদের দুর্ভোগ এখন চরমে । ত্রাণসামগ্রীর পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায়
মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে । রাস্তাঘাট ভেঙে পড়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা
বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পরিবহণ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়ায়
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর অভাব দেখা দিয়েছে । বিশুদ্ধ খাবার পানির
অভাবে ইতোমধ্যে দেখা দিয়েছে নানা ধরনের পানিবাহিত রোগ, যেমন— কলেরা,
টাইফয়েড, আমাশয়, ডায়রিয়া ইত্যাদি। এসব রোগের পাশাপাশি চর্মরোগেও
আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ৫ হাজার মানুষ । আশ্রয়হীন অনেক মানুষ খোলা আকাশের
নিচে অতিকষ্টে দিনাতিপাত করছে। অর্ধাহারে-অনাহারে মানুষে মানুষে চলছে
কাড়াকাড়ি, মারামারি। রোগ-ব্যাধিতে এবং খাদ্যের অভাবে তাদের জীবন দুর্বিষহ
হয়ে উঠেছে । বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন যে ত্রাণসামগ্রীর যোগান দিচ্ছে
তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল । তাদের এ অবস্থার অবসানকল্পে অবিলম্বে
খাবার, বিশুদ্ধ পানি এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন ।
বন্যা মোকাবিলায় করণীয়
বন্যা
আমাদের দেশের একটি চিরন্তন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হওয়ায় এ দুর্যোগকে প্রতিহত
করার ব্যাপারে সকলের সচেতন হওয়া অত্যাবশ্যক । এ বিষয়ে সরকারের পাশাপাশি
সকল শ্রেণির জনগণকেও সচেতন থাকতে হবে । এক্ষেত্রে বন্যার প্রকোপ দেখা দিতে
পারে এমন সব এলাকায় পূর্ব থেকেই বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে । যেমন—
বন্যা সতর্কীকরণ পূর্বাভাসের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা, বহুমুখী নিরাপদ
আশ্রয়স্থল নির্মাণ করা, বন্যাকালীন ত্রাণ-তৎপরতা বৃদ্ধি করা, বন্যা
পরবর্তী পুনর্বাসন কার্যক্রম গ্রহণ করা, কয়েকটি ফসলের চাষকালীন সময়ের
আংশিক পরিবর্তন করা, ভাসমান বীজতলা তৈরি করা ইত্যাদি । বন্যাকবলিত যেসব
এলাকায় নানা ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব লক্ষ করা যায়, সেখানে জরুরি
ভিত্তিতে চিকিৎসা সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। বন্যা পরবর্তী সময়ে
পুনর্বাসন কার্যক্রম জোরদার করা আবশ্যক । কুড়িগ্রাম এলাকায় পানি নেমে
যাওয়ার সাথে সাথে অতি দরিদ্রদের জন্য ১০০ দিনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে
বলে জানানো হয়েছে। এছাড়া টেস্ট রিলিফসহ অন্যান্য কার্যক্রমও হাতে নেওয়া
হবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এভাবে অন্যান্য বন্যাকবলিত এলাকাতেও
কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় । এসব ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি সরকারি ও
বেসরকারি পর্যায়ে সবসময় বন্যা প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি
পূর্বেই গ্রহণ করা প্রয়োজন ।
কুড়িগ্রামের মতো
অসংখ্য বন্যাকবলিত এলাকার দুর্দশা লাঘবে উপযুক্ত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা
সম্ভব হলে বন্যা পরিস্থিতি অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।